~ ভয়াল দুর্ঘটনা, এক তাল কাঁদামাটি, আর পত্রিকার ভুল — নোবেলের ইতিকথা ~
© Ragib Hasan
বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানীদের জন্য সবচেয়ে সম্মানের পুরস্কার হলো নোবেল পুরস্কার। পদার্থ, রসায়ন, ও চিকিৎসাবিজ্ঞান ছাড়াও শান্তি, সাহিত্য, এবং অর্থনীতিতে দেয়া হয় নোবেল। কিন্তু এই পুরস্কারের নামটা এলো কোথা থেকে? সবকিছুর মূলে আসলে আছে একটি দুর্ঘটনা, একটি বিস্ফোরন, এবং এক তাল কাদামাটি। কীভাবে? জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৮৬৪ সালে।
** পলকা বিস্ফোরক আর একটি দুর্ঘটনা **
নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তক হলেন সুইডিশ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী আলফ্রেড নোবেল। জন্ম ১৮৩৩ সালে। বাবার ছিলো অস্ত্রের কারখানা। কিন্তু ব্যবসা মন্দ যাওয়াতে সেটা লাটে উঠে। ভাবলেন, বিস্ফোরকের ব্যবসাতে নামা যেতে পারে। এহেন বিস্ফোরক যে কেবল যুদ্ধে ব্যবহৃত হয় তা নয়, পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো সহ আরো অনেক শান্তিপূর্ণ কাজে বিস্ফোরকের দরকার হয়। অনেকদিন ধরে একমাত্র বিস্ফোরক ছিলো বারুদ বা গানপাউডার। কিন্তু তার শক্তি খুব বেশি না। ১৮৪৬ সালে ইতালীয় রসায়নবিদ সোব্রেরো আবিষ্কার করেন প্রচণ্ড শক্তিশালী এক বিস্ফোরক তরল — নাইট্রোগ্লিসারিন। সেটা বানানো হতো গ্লিসারিনের মধ্যে নাইট্রিক অ্যাসিড ঢেলে। বিস্ফোরক হিসাবে এর শক্তি ছিলো বারুদের চাইতে অনেক বেশি। তবে সমস্যাটা অন্য জায়গায়, নাইট্রোগ্লিসারিন ছিলো খুব অস্থিতিশীল তরল। একটা মাছি উড়ে গিয়ে এর মধ্যে পড়লেও বিস্ফোরিত হয়। অথবা একচিলতে সূর্যের আলোর তাপেও এটা বিস্ফোরিত হতে পারে। ফলে এটা ব্যবহার করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটা ছিলো নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার।
১৮৬২ সালে নোবেল নাইট্রোগ্লিসারিন বানাবার কারখানা খুললেন। কী করে নাইট্রোগ্লিসারিনের অস্থিতিশীল অবস্থাটা ঠিক করা যায় যাতে করে দুর্ঘটনাবশত বিস্ফোরণ না ঘটে, তা নিয়ে নোবেল গবেষণা করতে লাগলেন। কিন্তু বিধি বাম। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাঁর ল্যাবে নাইট্রোগ্লিসারিনের পাত্রে হঠাৎ বিকট বিস্ফোরণ ঘটলো। মারা গেলো ৫ জন, এদের মধ্যে নোবেলের ছোটভাই এমিলও ছিলো। ভাইয়ের শোকে মুষড়ে পড়লেন নোবেল। কাজ বন্ধ থাকলো কিছুদিন। তার পর নতুন প্রত্যয়ে গবেষণা করতে লাগলেন। কীভাবে নিরাপদ করা যায় এই নাইট্রোগ্লিসারিনকে।
** সৌভাগ্যময় দুর্ঘটনা **
নোবেলের ভাগ্যটা পাল্টে গেলো আরেকটি দুর্ঘটনায়। একদিন ল্যাবে কাজ করার সময়ে হাত ফসকে এক বোতল নাইট্রোগ্লিসারিন পুরোটা পড়ে গেলো ল্যাবের মেঝেতে। আঁতকে উঠলেন নোবেল। লাফ দিয়ে লুকালেন নিরাপদ দূরত্বে। ভালো করেই জানেন, কতটা মারাত্মক এই বিস্ফোরক তরল। কিন্তু একী! কোনো বিস্ফোরণ তো ঘটলো না! দুরুদুরু বুকে তাকিয়ে দেখলেন, ল্যাবের মেঝেতে পড়ে থাকা একরকমের আঠালো বালি শুষে নিয়েছে নাইট্রোগ্লিসারিনের পুরোটা তরল। ফলে নাইট্রোগ্লিসারিন আর বিস্ফোরিত হয়নি। তো ল্যাবের মেঝেতে এই বালি এলো কোথা থেকে? ভালো করে খেয়াল করে দেখলেন নোবেল। আরে, এটা তো কাইজেলগুড় নামের বালিমাটির দলা। কয়দিন আগে বাক্সে করে নাইট্রোগ্লিসারিনের বোতল আনা হয়েছিলো ল্যাবে, সেই বাক্সের ভিতরে বোতলগুলো যাতে নড়াচড়া কম করে সেজন্য এই বালি দেয়া হয়েছিলো। বোতল বের করার সময়ে মেঝেতে পড়ে গেছে। ঝাড়ুদার কয়দিন না আসায় সাফ করা হয়নি মেঝে।
নোবেলের চোখ চক চক করে উঠলো। নাইট্রোগ্লিসারিন তরল অবস্থায় খুবই বিপদজনক, সহজেই বিস্ফোরিত হয়। তাই পরিবহন করা বা কোথাও গুদামে রাখাটা খুব বিপদজনক। কিন্তু এই বালিমাটিতে শুষে যাওয়ার পরে এটা একেবারে নির্বিষ হয়ে যায় যেন। হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেলেও এই বালিমাটিতে শুষে যাওয়া নাইট্রোগ্লিসারিনের কিছু হয় না। কিন্তু আবার বিস্ফোরণের ক্ষমতা লোপও পায় না — আগুন ধরালে বা ডেটোনেটর দিয়ে বিস্ফোরণের সূত্রপাত করলে ঠিকই বিস্ফোরণ ঘটে। নোবেল নানা রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বুঝে গেলেন, কী অনুপাতে নাইট্রোগ্লিসারিন আর বালিমাটি মেশালে সেটা নিরাপদ কঠিন বিস্ফোরকে পরিণত হবে। আর নাম দিলেন ডায়নামাইট (Dynamite)।
** সোনার খনি **
ডায়নামাইট এর আবিষ্কার পুরোপুরি পাল্টে দিলো খনি শিল্প, নির্মান শিল্প এবং অন্যান্য শিল্প যেখানে বিস্ফোরকের দরকার হয়। যেমন খনির ভিতরে নতুন কয়লা বা ধাতুর আকরিক পাথর খুঁড়ে বের করতে আগে যেখানে অনেক শ্রমিক দিয়ে অনেকদিন খোড়াখুড়ি করা লাগতো, এখন এক কাঠি ডায়নামাইট ফাটিয়ে সেটা সহজেই করা সম্ভব হলো। আবার পাহাড় কেটে রাস্তা বানাতে যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক দিয়ে পাথর ভাঙার দরকার হতো, খুব অল্প পরিমাণ ডায়নামাইট ফাটিয়ে সেই পাহাড় ভাঙার কাজটা হয়ে গেল খুব সহজ।
আর এই আবিষ্কারটা আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ালো নোবেলের জন্যও। সারা বিশ্বের সর্বত্র নির্মান ও খনি শিল্পে ডায়নামাইটের বিশাল চাহিদা — সেটা সরবরাহ করে নোবেল অল্প দিনেই হয়ে গেলেন কোটিপতি। শুধু তাই না, ডায়নামাইটের পরে এক এক করে আরো অনেক রকমের বিস্ফোরক পদার্থ উদ্ভাবন করলেন তিনি। সুইডেনের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসাবে স্থান করে নিলেন নোবেল।
** ভুলে ছাপানো শোক সংবাদ **
নোবেল যদি এভাবেই থাকতেন, তাহলে হয়তো আমরা তাঁকে অন্যভাবে জানতাম — ভাবতাম তিনি একজন অস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবসায়ী মাত্র। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা পাল্টে দিলো পত্রিকার ভুল করে ছাপানো একটা খবর। ১৮৮৮ সালে ফ্রান্সের ক্যান শহরে মারা গেলেন নোবেলের ভাই লুডউইগ নোবেল। সেখানকার এক পত্রিকা ভুল করে ভাবলো, আলফ্রেড নোবেলই মারা গেছেন। শোক সংবাদ ছাপলো বটে তারা, কিন্তু আলফ্রেড নোবেল সেটা পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। একী লিখেছে পত্রিকাটা? ভুল করে তারা ভেবেছে আলফ্রেড নোবেল মারা গেছেন, তাঁর পরিচয় লেখা হয়েছে কুখ্যাত অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসাবে। তাও যেন তেনভাবে না, পত্রিকায় বড় বড় হেডলাইনে শোক সংবাদ ছাপা হয়েছিলো এই শিরোনামে “Le marchand de la mort est mort”, অর্থাৎ মৃত্যুর ব্যবসায়ী লোকটা মরেছে! রিপোর্টের ভিতরে লেখা, “অনেক লোককে খুব সহজে মারার মতো বিস্ফোরকের আবিষ্কারক শয়তান-প্রতীম ডঃ আলফ্রেড নোবেল অবশেষে মরেছে!”।
রিপোর্টটা পড়ে আলফ্রেড নোবেল খানিক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তাঁর সম্পর্কে দুনিয়ার মানুষের এতোই খারাপ ধারণা! অবশ্য তাদের তো দোষ দেয়া যায় না। ডায়নামাইটের ভালো কাজে প্রয়োগের পাশাপাশি নানা যুদ্ধাস্ত্র ও বোমাতেও এর ব্যবহার হয়েছে। ফলে নানা যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ মারা পড়েছে বটে।
নোবেল ভাবলেন, এ জীবন ক্ষনস্থায়ী। গবেষণা আর ব্যবসা দেখতে গিয়ে নোবেল বিয়ে থা করেননি, সন্তানও নেই। তিনি মারা যাবার পরে লোকে কী বলবে, এই ভুল করে ছাপা শোক সংবাদ পড়ে সেটা তিনি বুঝে গেলেন। মরার পরেও লোকে তাকে অভিশাপ দিবে, ইতিহাসে লেখা থাকবে তার নাম মৃত্যুদূত হিসাবে! না না, এ হয় না — ভাবলেন নোবেল।
** জন্ম হলো নোবেল পুরস্কারের **
কিন্তু কীভাবে নিজের নামটার কুখ্যাতি দূর করা যায়। কীভাবে মানবজাতির কল্যাণে কাজে লাগাবেন তাঁর এতো কাড়ি কাড়ি টাকা? অনেকদিন ধরে চিন্তা করলে নোবেল। তারপর একটা আইডিয়া মাথায় আসলো। তাঁর সব সম্পদ তিনি মানবজাতির কল্যাণে দান করে যাবেন। আর তা করবেন জ্ঞান বিজ্ঞান কলা ও শান্তির জন্য পুরস্কার দিয়ে। ১৮৯৪ সালে তিনি উইল করে দান করে গেলেন তাঁর সব সম্পত্তি। তখনকার হিসাবে সেটা প্রায় দেড় মিলিয়ন পাউন্ডের মতো — বর্তমানের হিসাবে ধরতে গেলে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২ হাজার কোটি টাকা। উইল বা অছিয়ত নামায় লিখে গেলেন, তাঁর এই সম্পত্তি ব্যাংকে রেখে যা আয় হবে প্রতিবছর, তা দিয়ে ৫টি পুরস্কার দেয়া হবে। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য, এবং শান্তিতে দেয়া হবে এই পুরস্কার। প্রতিটি পুরস্কার সর্বোচ্চ তিন জনকে দেয়া হবে এইসব ক্ষেত্রে মানবজাতির কল্যাণে অবদান রাখার জন্য।
এক বছর পরে ১৮৯৬ সালে নোবেলের মৃত্যু হয়। তাঁর দান করে যাওয়া অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় নোবেল ফাউন্ডেশন, যা ১৯০১ সাল থেকে চালু করে বিশ্ববিখ্যাত এই নোবেল পুরস্কার। আজ বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত পুরস্কার হিসাবে যা দেয়া হয় বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, ও শান্তিকামী মানুষদের।
নোবেল বুঝতে পেরেছিলেন, অর্থ উপার্জনই জীবনের একমাত্র সার্থকতা নয়। বরং জনমানুষের উপকারে আসতে পারাটাই জীবনের আসল সাফল্য। নোবেল জীবনের শুরুতে বিস্তর অর্থ কামিয়েছিলেন বিস্ফোরক বানিয়ে, কিন্তু জীবনাবসানের পরে সেই অর্থ যেন মানবকল্যানে লাগে, তা নিশ্চিত করে গেছেন নোবেল পুরস্কারের মাধ্যমে। আমরা তাই নোবেলকে মনে রাখি তার ভয়াবহ সব বিস্ফোরকের জন্য নয়, বরং তাঁর হাতে প্রবর্তিত মানবকল্যাণের এই পুরস্কারের জন্যই। নোবেলের জীবনটা তাই লেখা থাকবে পৃথিবীর ইতিহাসে, মৃত্যুব্যবসায়ী হিসাবে নয়, বরং জনমানুষের উপকারে আসা বিজ্ঞান, কলা, ও শান্তির পৃষ্টপোষক হিসাবে।
(বিজ্ঞানীদের কাণ্ড কারখানা – Bigganider Kando Karkhana বইয়ের আসন্ন ৩য় খণ্ড থেকে একটি নতুন লেখা)
#বিজ্ঞানীদেরকাণ্ডকারখানা #এলোচিন্তা
(ছবিসূত্র – উইকিমিডিয়া কমন্স)
মন্তব্য করুন