কেউ যদি বলে যে সূর্যকে কেন্দ্র করে সৌরজগতের সব গ্রহ ঘুরছে না, তবে আপনার কেমন লাগবে? সৌরজগতের ৮ গ্রহ তাদের নক্ষত্র সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে- এটা একটা চিরন্তন সত্য ঘটনা বলা যায়। এটাই পড়ে আসছি সেই ছোটবেলা থেকে। তাহলে বড়বেলায় এসে মিথ্যা হয়ে যাবে কেন! আসলে সৌরজগতের গ্রহগুলোর মধ্যে ৭ টি গ্রহই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সমস্যাটা হয়েছে গ্রহরাজ বৃহস্পতিকে নিয়ে। জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের নিখুঁত বিচারে গ্রহরাজ সূর্যের চারিদিকে ঘুরলেও নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনে এতটুকুও ছাড় দেয়নি। সূর্যের ঘূর্ণনেও প্রভাব বিস্তার করেছে এমনভাবে যে সূর্যপৃষ্ঠের সামান্য বাইরে মহাশূন্যের একটি নির্দিষ্ট জায়গাকে কেন্দ্র করে সূর্য ও বৃহস্পতি উভয়ই ঘুরছে। এ যেন দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা।
আংগুলের ডগায় একটি স্কেলের ঠিক মাঝের অংশ রেখে এটিকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রাখা যায়। কিন্তু আপনি কি পারবেন, একটি হাতুরীর মাঝের অংশকে আংগুলের ডগায় রেখে ভারসাম্যপূর্ণভাবে ধরে রাখতে। পারবেন না, কারণ স্কেলের মধ্যবিন্দু থেকে দুই দিকেই সমান কিন্তু হাতুরীর একপ্রান্তের লোহার ভর অন্যপ্রান্তের কাঠের ভর থেকে অনেকগুন বেশি ভারী। একইভাবে আপনি যদি নাট-বল্টু ঘোরানোর রেঞ্জের কথা চিন্তা করেন দেখবেন এর মাথার দিকে ভর বেশি আর হাতলের দিকে কম ভারী। এটাকে যদি আংগুলের ডগায় রেখে ভারসাম্য আনতে চাই তাহলে আংগুল রেঞ্জের মাথা অর্থাৎ ভারী প্রান্তের দিকে রাখতে হবে, মধ্যবিন্দুতে নয়। এই বিন্দুকে বলা হয় ভারকেন্দ্র। সুষম ভরের কোন বস্তুর ভারকেন্দ্র থাকে মাঝখানে, আর অসম ভরের যেকোন জিনিসের ভারকেন্দ্র থাকে ভারী প্রান্তের দিকে। জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে দুইটি বা ততোধিক বস্তুর মধ্যে এধরণের ভারকেন্দ্রকে বলা হয় (Barycenter)।
ছোটবেলায় যা পড়ে এসেছেন তা এখন মাথা থেকে দূর করে দিন। সূর্যকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতি ঘুরছেনা বরং সূর্যের কাছাকাছি মহাশূন্যের একটি জায়গাকে কেন্দ্র করে সূর্য ও বৃহস্পতি উভয়ই ঘুরছে। তাদের ঘূর্ণনের ঘটনাটি ঘটছে চিরায়ত বলবিদ্যার Two Body Problem অনুযায়ী। এখানে বলা হয়েছে দুইটি অসম ভরের বস্তু একটি নির্দিষ্ট বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘুরতে চায়, কম ভরের বস্তুটি বেশি ভরের বস্তুকে কেন্দ্র করে ঘোরে না বরং একটি নির্দিষ্ট বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘোরে যা ঐ বস্তু দুইটির ভর ও কেন্দ্রের মধ্যবর্তী দুরত্বের উপর নির্ভরশীল। যদি বস্তু দুইটির ভর m1 এবং m2 হয়, মধ্যবর্তী দুরত্ব a হয় তবে m1 বস্তু থেকে বেরিসেন্টারের দুরত্ব,
R1 = a/(1+ m1/m2)
### সূর্য ও পৃথিবীর ভর ও মধ্যবর্তী দুরত্ব উপরের সূত্র অনুযায়ী বসালে সূর্যের কেন্দ্র থেকে বেরিসেন্টারের দুরত্ব হয় ৪৪৯ কিমি। তাহলে কি পৃথিবীও সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে না? বিস্মিত হবেন না, পৃথিবী সূর্যকেই কেন্দ্র করে ঘুরছে কিন্তু সূর্যের কেন্দ্রকে নয় বরং সূর্যের কেন্দ্র থেকে ৪৪৯ কিমি দূরের একটি জায়গাকে। যেহেতু সূর্যের ব্যাসার্ধ ৬৯৬০০০ কিমি, তাই বেরিসেন্টারটি সূর্যের মধ্যেই আছে। একইভাবে পৃথিবী ও চাঁদের বেরিসেন্টার নির্ণয় করলে দেখা যায় চাঁদ পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে ৪৬৭০ কিমি দূরের একটি জায়গাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এক্ষেত্রেও এটি পৃথিবীর মধ্যেই পড়ছে যেহেতু পৃথিবীর ব্যাসার্ধ ৬৩৮০ কিমি। কিন্তু গ্রহরাজ বৃহস্পতি ও আমাদের নক্ষত্র সূর্যের ক্ষেত্রে এই হিসেব করলে দেখা যায় বেরিসেন্টার সূর্যকেন্দ্র থেকে ৭৪২০০০ কিমি দূরে যেখানে সূর্যের ব্যাসার্ধ ৬৯৬০০০ কিমি। অর্থাৎ এদের ক্ষেত্রে বেরিসেন্টার সূর্যের বাইরে চলে যাচ্ছে।
এজন্যই বলা হয়, টেকনিক্যালি বৃহস্পতি সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে না বরং সূর্যের বাইরের একটি জায়গাকে কেন্দ্র করে উভয়ই ঘুরছে। সৌরজগতের অভ্যন্তরে এরকম ঘটনা আরও আছে। বামন গ্রহ প্লুটো ও তার চাঁদ শ্যারনের মধ্যেও বেরিসেন্টার প্লুটোর বাইরে অবস্থিত। এজন্য এদেরকে বাইনারি সিস্টেম বলা হয়।
সূর্য ও বৃহস্পতি এই মহাবিশ্বের প্রতিটি ঘূর্নায়মান বস্তুই একটি বেরিসেন্টারকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। প্রতিটি গ্রহ-উপগ্রহ, গ্রহ-নক্ষত্র একটি বেরিসেন্টারকে কেন্দ্রে করে ঘোরে। ভরের পার্থক্য ও দুরত্বের উপর ভিত্তি করে বেরিসেন্টারটি কখনও বেশি ভরের বস্তুর ভিতরে আবার কখনও বাইরেও হতে পারে। বৃহস্পতি গ্রহের ভর আমাদের সৌরজগতের সব গ্রহগুলোর মোট ভরের প্রায় ৭০ শতাংশ। এজন্যই এর বেরিসেন্টার সূর্যের অভ্যন্তরে না থেকে বাইরে মহাশূন্যের একটি স্থানে হয়েছে। গ্রহরাজের ভর আর একটু বেশি হলে এর ভিতরে মহাকর্ষীয় চাপে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি হত অর্থাৎ নিউক্লিয়ার ফিউশন হত, ফোটন তৈরি হত, এটি একটি নক্ষত্রে পরিণত হত। এজন্যই বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ কার্ল স্যাগান বৃহস্পতিকে ‘ব্যর্থ নক্ষত্র’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছিলেন, ‘বৃহস্পতির ভর আর একটু বেশি হলেই আমরা দ্বি-নাক্ষত্রিক জগতের বাসিন্দা হতাম’।
সৌরজগতের বাইরে কোন নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘূর্নায়মান গ্রহকে বলে এক্সোপ্লানেট। বেরিসেন্টার এর তত্ত্ব ব্যবহার করে এক্সোপ্লানেট আবিষ্কার করা হয়। ভাবছেন কিভাবে? দূরবর্তী নক্ষত্রের উজ্জ্বল প্রভার কারণে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের গ্রহগুলি টেলিস্কোপে ধরা পড়েনা। টেলিস্কোপে শুধু উজ্জ্বল প্রভার নক্ষত্র দেখা যায়। যদি এটা দেখা যায় যে নক্ষত্রটি নিজের কেন্দ্র ছাড়া অন্য জায়গাকে কেন্দ্র করে আবর্তন করছে অর্থাৎ একটু হলেও বিষমভাবে ঘুরছে তাহলেই বুঝা যায় কোন একটি গ্রহের কারণে এটি বেরিসেন্টারকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। বেরিসেন্টারের পাশাপাশি আরো কয়েকটি পদ্ধতি ব্যবহার করে জ্যোতির্বিদরা অনেক এক্সোপ্লানেট ও এর ডিটেইলস সম্পর্কে জেনেছে।
Source: Ainul Islam Munna
মন্তব্য করুন