একটি প্রবাদ বাক্য আছে। কুর্দিদের নাকি পাহাড় বাদে কোনো বিশ্বস্ত বন্ধু নেই। মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে থাকা প্রায় তিনকোটি কুর্দি জনগোষ্ঠীতে প্রবাদটি খুব প্রচলিত। এই সপ্তাহে প্রবাদটির যথার্থতা কুর্দিরা আরেকবার টের পাচ্ছেন।কুর্দিরা মধ্যপ্রাচ্যের চতুর্থ বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে কুর্দিরা মূলত সুন্নি মুসলিম। সুন্নি মুসলিমরা সংখ্যায় প্রায় ৮০%। এছাড়া ১৫% শিয়া মুসলিম। আর অবশিষ্ট ৫% কুর্দি খ্রিস্টিয়ান, ইহুদি, ইয়াজিদি, ইয়ারসানি, মানদিয়ান, বাহাই, জরথুস্ত্র এবং নির্ধর্মী। জাতিগতভাবে কুর্দিরা ধর্মপ্রসঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদি। সুন্নি এবং শিয়া উভয় ভাগের মুসলিমদের মধ্যে সুফিবাদের ব্যপক প্রভাব লক্ষণীয়।গত আঠারো শতক থেকে এরা নিজেদের জন্য একটা পৃথক দেশের জন্য চেষ্টা–সাধনা করছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৮ সালে যখন যুদ্ধবিরতি কার্যকর ছিল তখন কুর্দি অধ্যুসিত অঞ্চলে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সহায়তায় একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছিল। যুদ্ধবিরতি শেষ হলে তুর্কীরা আবার যখন যুদ্ধে ফিরে আসে তখন ব্রিটেন এবং ফ্রান্স প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ফলে স্বাধীন কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠার প্লান ভেস্তে যায় এবং কুর্দি অধ্যুসিত অঞ্চলটি ইরাক–সিরিয়া এবং তুরষ্কে বিভক্ত হয়ে পড়ে।গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউস সিদ্ধান্ত নেয় যে, সিরিয়ার কুর্দী অধ্যুসিত অঞ্চলে তুর্কী সেনা অভিযানের মুখে তারা বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। বিষয়টি আমেরিকার ক্ষেত্রে আশ্চর্যজনক নয়। এটি তাদের ব্যবহার করা আর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ছুড়ে ফেলার খামখেয়ালি চরিত্রের একটি পুনরাবৃত্তি মাত্র।
১৯৭৫ সালে ইরানের শাহে’র সাথে সাদ্দাম হোসাইনের যুদ্ধ চলছিল। তখন কুর্দি পেশমের্গা যোদ্ধাদের সাদ্দামের বিরূদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ইন্ধন দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি সাদ্দাম হোসেনকে কুর্দিদের বিরূদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। সাদ্দাম হোসাইন হঠাৎ শাহে’র সঙ্গে সন্ধি করলেন। সন্ধির কারণে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায় ফলে কুর্দিদের প্রয়োজনও ফুরিয়ে আসে। তাদেরকে অস্ত্র ও অর্থ দেওয়া বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তখন ইরাকি বাহিনীর আক্রমণের মুখে ফাঁদে আটকে পড়েন সবসময় অন্যের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হওয়া কুর্দী যোদ্ধারা।আশির দশকে সাদ্দামের সাথে আমেরিকার রোনাল্ড রিগ্যান প্রশাসনের খাতির বৃদ্ধি পায়। ইসলামিক হয়ে ওঠা নতুন ইরানের বিরূদ্ধে তখন সাদ্দাম হোসেন আমেরিকার হয়ে ইরানের বিরূদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছেন। ১৯৮৮ তে আমেরিকার নিরব ভূমিকায় কূর্দি জনগোষ্ঠী ইরাকের সেনা বাহিনীর কেমিক্যাল হামলার শিকার হন। সাদ্দাম নাখোশ হতে পারেন তাই যুক্তরাষ্ট্র এটা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। হালাবযায় ইরাকের বোমা হামলায় প্রায় পাঁচহাজার কুর্দি নিহত হন। অভিযোগ আছে তখন কেমিক্যাল অস্ত্র ব্যবহার করেছিল ইরাক।আমেরিকার সাথে সাদ্দাম হোসেনের হানিমুন বেশিদিন টেকেনি। ১৯৯০ সালে কুয়েতে আক্রমণ সাদ্দামকে আমেরিকার শত্রুতে পরিণত করে। তখন বুশ প্রশাসন ইরাকের শিয়া ও কুর্দিদেরকে সাদ্দামের বিরূদ্ধে বিদ্রোহে উস্কে দেয়। এ সময় ইরাকের উত্তরাঞ্চলে ব্রিটেনের উদ্যোগে নো ফ্লাই জোন হলে সে সুযোগে কুর্দিদের একটি স্বায়ত্বশাসিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু আমেরিকার পর্যাপ্ত সহায়তা না পাওয়ায় পরিণামে এ রাষ্ট্রটিও ব্যর্থ হয় এবং ইরাকি সেনাদের হাতে নিষ্পিষ্ট হয়।কুর্দিদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুরষ্কের অভ্যন্তরে সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ নেয়। আশির দশকে পিকেকে গঠিত হয়। তারা তার্কিশ গভর্মেন্টের বিরূদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের সূচনা করে। গত পঁয়ত্রিশ বছরে পিকেকের সহিংস হামলায় প্রায় চল্লিশ হাজার লোক নিহত হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা-ব্রিটেন এবং আরো কিছু ইউরোপিয় রাষ্ট্র পিকেকে’কে সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের বিশৃঙ্খলার মধ্যে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর নিকট থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু শহরের নিয়ন্ত্রণ কুর্দিরা নিয়ে নেয়। ২০১৪ সালের পর যখন আইসিস তাদের অঞ্চল বিস্তৃত করতে আরম্ভ করে তখন কুর্দিরা সিরিয়ার হয়ে আইসিসের বিরূদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। আইসিসের বিরূদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া হয়ে বিশ্বস্ত মিত্র খুঁজছিল। যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিদেরকে আইসিসের বিরূদ্ধে যুদ্ধে প্রথমে বিমান হামলা করে সহায়তা দিয়েছে। অবশেষে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে শুরু করেছে। কিন্তু কুর্দি–যুক্তরাষ্ট্রের এই বিকাশমান মৈত্রী তুরষ্কের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান সতর্ক সংকেত বাজিয়ে যাচ্ছিল।গত সপ্তাহে তুরস্কের প্রসিডেন্ট ফোনে কথা বলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে। পিকেকে’কে তুর্কি সীমান্ত থেকে সরিয়ে দিতে অনেক আগে থেকেই সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সামরিক অভিযান চালানোর চেষ্টা করছিল তুরষ্ক। এক্ষেত্রে প্রধান বাঁধা ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ অঞ্চলে তাদের কিছু সেনা ঘাটি ছিল। এরদোগানের সাথে ফোনালাপে সেনাঘাটিগুলো সরিয়ে নিতে সম্মত হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে তার নিজের প্রশাসনেরও অনেকে বিস্মিত হন। কারণ এ সিদ্ধান্তের ফলে কয়দিন আগেও আইসিসের বিরূদ্ধে যুদ্ধে তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র পিকেকে’র বিরূদ্ধে তুরষ্কের সমরাভিযানের পথ খুলে যাবে। এবারো কুর্দিদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের চিরাচরিত নীতির পুনরাবৃত্তি ঘটল। “প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ছুড়ে ফেলো।”
Leave a Reply