সুর শব্দটা অাসলেই অামাদের মনের উঁকি দেয় গান। অার অামরা জানি অামাদের এই দেশের মানুষ কতোটা গান পাগল। গান অামাদের জীবনের খোরাক। অার সেই গানই অামাদের ভাল লাগে, হয়ে ওঠে জীবনের গান যখন সেই গানে পড়ে প্রকৃত সুরের লেপন। ঠিক সুরের জন্যই একটি গান পায় জীবন, হয় প্রাণবন্ত, শ্রুতিমধুর। তাইতো সুর, সংগীতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অার এই দেশের সংগীতের সেই গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে অসামান্য অবদান যিনি রেখেছেন তিনি সত্য সাহা। তাঁর পরশেই যেন বাংলা চলচ্চিত্রের গান হয়েছে শ্রুতিমধুর অার তিনি হয়েছেন অমর।
কিংবদন্তী এই সুরকারের জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৫শে ডিসেম্বর উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার নন্দীরহাট “”লক্ষী সাহার”” জমিদার বংশে। জমিদার প্রসন্ন কুমার সাহার প্রথম স্ত্রীর গর্ভে জন্ম হয় সত্য সাহার। অার শিক্ষা জীবনে তিনি ১৯৪৬-৪৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে নারায়ণগঞ্জের রামকৃষ্ণ স্কুল থেকে এণ্ট্রান্স পাশ করেন। পরে তিনি ১৯৫১-৫২ সালে ভারতের কলকাতা বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বি. এ পাশ করেন।
এতো গেল তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন। অার সংগীতে হাতেখড়ি হয় তাঁর পিতৃতুল্য রবীন্দপাল সাহার কাছে। অার পরবর্তীতে তিনি পন্ডিত সুপর্ণা নন্দীর কাছে তালিম নেন উচ্চাঙ্গ সংগীতে। এই সময়ে তিনি ভজন গানেও পারদর্শিতা অর্জন করেন।
বাংলা সংগীতের সুরের এই মহাপুরুষ সত্য সাহা ছিলেন একাধারে গায়ক, সুরকার, সংগীত পরিচালক, চিত্র প্রযোজক এবং পরিচালক। এতো সবের মধ্যে তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ও পরিচয় ছিল সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে। হয়তো সেই কারণেই তিনি তাঁর কর্ম জীবন শুরু করেন ১৯৫৬ সালে বাংলাদেশ বেতারের সুরকার পঞ্চানন মিত্রের সহকারী হিসেবে। অার ১৯৫৮-৫৯ সালের মধ্যে তিনি সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবে সংগীত পরিচালনা করেন বারোটি চলচ্চিত্রের। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, তিনি ছিলেন একজন গুণী শিল্পীও। সেই কারণেই তিনি ১৯৬১ সালে বেতারের শিল্পী হিসেবে হন তালিকাভুক্ত।
অার এরপরেই তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে অাত্মপ্রকাশ করেন সংগীত পরিচালক রূপে। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সুতরাং’ (১৯৬৪) চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই তিনি চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রবেশ করেন সংগীত পরিচালক হয়ে। এই চলচ্চিত্রে তাঁর জনপ্রিয় বিখ্যাত গানটি, ‘তুমি অাসবে বলে, ভালবাসবে বলে’। তবে এর অাগে তিনি সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন ‘জানাজানি’ চলচ্চিত্রের। কিন্তু এই চলচ্চিত্রটি ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রের পরে মুক্তি পাওয়ার কারণে সংগীত পরিচালক হিসেবে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ধরা হয় ‘সুতরাং’কেই। তবে তিনি এর অাগেও বেতারে থাকা অবস্থায় ‘তোমার অামার’ চলচ্চিত্রে কন্ঠ শিল্পী হিসেবে পরিবেশন করেন গান।
চলচ্চিত্রে তাঁর সুর ও সংগীত পরিচালনায় জনপ্রিয় ও শ্রোতানন্দিত এমন কিছু গান যেমন, ‘নীল আকাশের নিচে আমি’, ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা’, ‘দুঃখ আমার বাসর রাতের’, ‘চিঠি দিও প্রতিদিন’, ‘আমার মন বলে তুমি আসবে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’, ‘মাগো মা ওগো মা’, ‘তুমি কি দেখেছো কভু’, ‘ঐ দূর দূরান্তে’, ‘তোমারই পরশে জীবন আমার’ সহ অারো অনেক।
এছাড়া তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনায়ও রেখেছেন তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব। সত্য সাহা ও তাঁর স্ত্রী রমলা সাহার প্রযোজনায় নির্মিত বাংলাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘অশিক্ষিত’ ও ‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবির কাহিনী, চিত্র, সংলাপ ও সঙ্গীত ঐসময়ে ব্যাপক সাড়া জাগায়। বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্কটকালে এই চলচ্চিত্র দুটি অসংখ্য দর্শকের মনে করে নেয় স্থান। সত্য সাহার সযত্ন সঙ্গীত পরিচালনায় এ ছবির গানগুলিও হয় অত্যন্ত জনপ্রিয়।
গুণী এই সংগীত পরিচালক এবং সুর স্রষ্টা অামাদের মুক্তিযুদ্ধেও রাখেন তাঁর অসাধারণ কর্মের উদাহরণ। তিনি ১৯৭১ সালে কলকাতার স্বাধীন বাংলা শিল্পী সংসদেও করেন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ। এই সময়ে বাংলার বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের উদ্যোগে ‘লিবারেশন ওয়ার ফিল্মস’ নামে নির্মিত হয় চারটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। যার মধ্যে ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘এস্টেট ইজ বর্ণ’ এর পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান নিজে। অার অপর দুটির মধ্যে অালমগীর কবির পরিচালনা করেন ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ এবং বাবুল চৌধুরী পরিচালনা করেন ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’। এই চারটি চলচ্চিত্রই বিশ্বজুড়ে সৃষ্টি করেছিল অালোড়ন। অার এই চারটি চলচ্চিত্রেরই সংগীত পরিচালনা করেন সত্য সাহা।
এছাড়াও তাঁর সুরের যাদুতে অমর হয়ে অাছে চলচ্চিত্র ছাড়াও অনেক অাধুনিক গান। যা অাজও শ্রোতাদের কাছে সমানভাবে নন্দিত। তাঁর সম্পর্কে অারেকটি কথা না উল্লেখ করলেই নয়। অার তা হলো কবিতায় সুরারোপের ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য দক্ষতা। তিনি তাঁর সেই সুকৃতি দেখিয়েছেন শামসুল রহমানের অসাধারণ ‘মা’ কবিতায় সুরের প্রয়োগ করে। সুর করেছেন তিনি ‘সূর্যকন্যা’ চলচ্চিত্রে ফজল শাহাবুদ্দীনের কাব্যধর্মী লেখা ‘অামি যে অাঁধারে বন্দিনী’ ও ‘চেনা চেনা লাগে’ গানের। অার লোক সংগীতে তাঁর ঈর্ষণীয় দক্ষতা অামাদেরকে করে অভিভূত।
তিনি তাঁর দীর্ঘ সংগীত জীবনে অর্জন করেছেন অনেক পুরস্কার এবং পেয়েছেন অসংখ্য মানুষের ভালবাসা। সত্য সাহা চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা ও সুর প্রদানের জন্য লাভ করেন তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ১৯৯৪ সালে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক – ‘আগুনের পরশমণি’। ১৯৯৬ সালে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক – ‘অজান্তে’ এবং ২০০১ সালে শ্রেষ্ঠ সুরকার – ‘চুড়িওয়ালা’ সিনেমার জন্য। এছাড়াও তিনি সঙ্গীতে অবদানের জন্য ২০১৩ সালে লাভ করেন মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার। অার সঙ্গীতশিল্পী এবং সঙ্গীত পরিচালনায় তাঁর কৃতিত্বের জন্য তিনি ১৯৭৪ সালে অর্জন করেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থা পুরস্কার।
গুণী এই সংগীত ব্যাক্তিত্ব এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে কাঁদিয়ে পরলোক গমণ করেন ১৯৯৯ সালের ২৭ জানুয়ারী ঢাকায়।
এদেশে সংগীতের এক বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। শ্রুতিমধুর বহু গানের এক অনন্য স্রষ্টা। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের গানের বরপুত্র। অাজো তিনি তাঁর অমর সৃষ্টি ভান্ডার দিয়ে মোহিত করে রেখেছেন অসংখ্য শ্রোতা কে। সত্য করেই বলতে হয়, যদি তিনি এই দেশে জন্ম না নিতেন, তবে অাজ অামরা চলচ্চিত্রের স্বর্ণালী দিনের গান নিয়ে যে গর্ব বোধ করি তা হয়তো সম্ভবই হতো না। সম্ভব হতো না অসাধারণ অমর সব শ্রুতিমধুর গান শোনার। তাইতো তিনি বেঁচে অাছেন, থাকবেন এদেশের লক্ষ কোটি গান প্রেমী মানুষের হৃদয়ে।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার
১৯৯৪: শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক – আগুনের পরশমণি
১৯৯৬: শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক – অজান্তে
২০০১: শ্রেষ্ঠ সুরকার – চুড়িওয়ালা
*সত্য সাহার পুত্র বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র সুরকার, সংগীত পরিচালক ****সত্য সাহা****।
***জমিদার লক্ষীচরণ সাহার এই বাড়িটি নির্মাণ হয় ১৮৯০ সালে।উনি এবং উনার অপর ২ ভাই মিলে ওই এলাকায় জমিদারি সূচনা করেন।
এরপর জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি ঘটলে এই জমিদারির পতন ঘটে।
***
সুরারোপিত চলচ্চিত্র :
সুতরাং (১৯৬৪)
রূপবান (১৯৬৫)****
১৩নং ফেকু ওস্তাগর লেন (১৯৬৬)
ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো (১৯৬৬)
ভাওয়াল সন্ন্যাসী (১৯৬৬)
চাওয়া পাওয়া (১৯৬৭)
আয়না ও অবশিষ্ট (১৯৬৮)
মোমের আলো (১৯৬৮)
এতটুকু আশা (১৯৬৮)
বাঁশরী (১৯৬৮)
আবির্ভাব (১৯৬৮)
নীল আকাশের নিচে (১৯৬৯)***
আলিঙ্গন (১৯৬৯)
দীপ নেভে নাই (১৯৭০)
বিনিময় (১৯৭০)
সাধারণ মেয়ে (১৯৭০)
নতুন প্রভাত (১৯৭০)
সমাধান (১৯৭২)
মানুষের মন (১৯৭২)
অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২)
স্বীকৃতি (১৯৭২)
স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা (১৯৭৩)
অতিথি (১৯৭৩)
পরিচয় (১৯৭৪)
আলোর মিছিল (১৯৭৪)
ধন্ন্যি মেয়ে (১৯৭৫)
চাষীর মেয়ে (১৯৭৫)
গড়মিল (১৯৭৬)
নয়নমনি (১৯৭৬)
সূর্য কন্যা (১৯৭৬)
অমর প্রেম (১৯৭৭)
বসুন্ধরা (১৯৭৭)
অশিক্ষিত (১৯৭৮)
অলংকার (১৯৭৮)
অগ্নিশিখা (১৯৭৮)
মাটির ঘর (১৯৭৯)
জিঞ্জির (১৯৭৯)
ছুটির ঘণ্টা (১৯৮০)
লাল সবুজের পালা (১৯৮১)
জনতা এক্সপ্রেস (১৯৮১)
লাল কাজল (১৯৮২)
জনতা মটর (১৯৮২)
পুরস্কার (১৯৮৩)
মায়ের আঁচল (১৯৮৪)
ইনসাফ (১৯৮৫)
গুনাই বিবি (১৯৮৫)
অপেক্ষা (১৯৮৭)
সন্ধি (১৯৮৭)
বীরঙ্গনা সখিনা (১৯৮৯)
শ্বশুর বাড়ী (১৯৯১)
প্রিয় পদরেখা (১৯৯২) – টিভি নাটক
আগুনের পরশমণি****
অজান্তে (১৯৯৬)
দীপু নাম্বার টু (১৯৯৬) *****
নিমফুল (১৯৯৭) – টিভি নাটক
চুড়িওয়ালা (২০০১)
সুর করা জনপ্রিয় গানের তালিকা :
*চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা
*বন্ধু হতে চেয়ে তোমার
*আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল
*তোমারই পরশে জীবন আমার
*তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়
*ঐ দূর দূরান্তে
*নীল আকাশের নিচে আমি
*এক নদীরই উজানভাটি
*মাগো মা ওগো মা
*চিঠি দিও প্রতিদিন
*রূপালী নদীরে
পরানে দোলা দিলো
*সাতটি রঙের মাঝে আমি
*এই পৃথিবীর পরে
*হেসে খেলে জীবনটা
*যার ছায়া পড়েছে
*চিঠি দিও প্রতিদিন
*আমি নিজের মনে নিজেই যেন
*বন্ধু হতে চেয়ে তোমার
*তুমি আসবে বলে, ভালবাসবে বলে
*ঢাকা শহর আইসা আমার…
গান হয়ে এলে
ভালোবাসা এমন একটি
গাঙ বাঁকা জানি
সত্যসাহা সুরারোপিত স্বর্ণালী গান
সৃজনশীল ক্ষণজন্মা মানুষের কি মৃত্যু হয়? শ্রুতিমধুরতার কারণে তিনি বেঁচে থাকবেন গানে গানে, প্রতিটি শ্রোতার কানে কানে।
অশিক্ষিত বাংলা ছায়াছবি — YouTube Link
১৯৭৫ সালের মাঝমাঝিতে সত্য সাহা উনার প্রযোজনায় বাংলা ছবি ‘ অশিক্ষিত’ নির্মাণ করেন – যার শ্যুটিং হয় এই জমিদারবাড়িতে এবং টানা ১৮ দিন এর শ্যুটিং চলে।
মন্তব্য করুন